শ্রী অজয় চট্টোপাধ্যায়
Guest Post
বহু বছর পর এবার পুজোতে বাড়ি মানে বেলুনগ্রামে যেতে পারিনি।ভীষণ খারাপ লাগছিল।যদিও ভাই এর অকাল প্রয়াণে পুজোয় গ্রামের বাড়ি যাওয়ার আগের সে আনন্দ, সে আবেগ সে আকুলতা আজ আর আসে না।বড় ফাঁকা লাগে ।
গ্রামে যেতে না পারাতে আমার বৌয়ের কয়েকশো কান্নাকাটি হয়ে গেল।প্যাণ্ডেল ঘুরে পুজো দেখার অভ্যেস আমার নেই।তারপর মৌসুমীর শিরদাঁড়ায় চোট।সব মিলিয়ে পূজো প্রায় ঘরে বসে কাটলো।
“সপ্তমি অষ্টমী তিথি তুমি গত হয়ো না
কানছে রানি ধুলায় পড়ে প্রাণে বাঁচে না
বিজয়া দশমী তিথি তুমি গত হয়ো না
গৌরী গেল কৈলাসে সম্বৎসর আসবে না…….. ।”
For the lyrics of this song, read The legacy of the Bengali Agomoni Songs
ভাসানের পরে এই গানের টান ছোটো ভাই মারা যাওয়ার পর আগের মতো আর অনুভব না করলেও এই গানের চিরন্তন এক আকর্ষণ আছে যা আমাকে আজও টানে।ছোটো থেকে বাবা কাকার গলায় এই ‘চিরন্তনী’ শুনে এসেছি।গৌরীর বিদায়ের গান।চারদিনের আনন্দ মুখর দিনগুলি কাটিয়ে আমাদেরও ফেরার গান।বৎসর কাল পরে গৌরী আবার আসবে এই আশা নিয়ে যে যার কর্মজীবনে ফিরে যাওয়ার গান।
প্রতিমা নিরঞ্জনের পর এটা ছিল আমাদের ঘরে ফেরার গান।সেই কোন কাল থেকে এক ভাবে চলে আসছে।ভাসান হয়ে গেলে কালীতলায় চলো।সেখানে কাঁচা হলুদ মুখে দেওয়া ও গেলা। কামড়ানো চলবে না।তারপর উপস্থিত গুরুজনদের সবাইকে প্রণাম করার ধূম।সমবয়সীদের সাথে কোলাকুলি।শেষে ঢাকের তালে তালে এই গান গাইতে গাইতে ভগবতী তলায় ফেরা।এই সেদিনও মনে হতো ভগবতীতলা যেন এখনি না আসে।গান যেন শেষ না হয়।গান শেষ হলে ভগবতীতলায় পৌঁছে গেলে মনে হতো সব শেষ।
বিভিন্ন সময় ছোটো কাকা, বাবা, লিচুকাকা ছিলেন সূত্র ধারক।মনপ্রাণ দিয়ে এই গানের বোল ধরতেন।তারা আজ আর কেউ নেই।
একবার প্রচণ্ড বৃষ্টিতে কালীতলা থেকে ভগবতী ঘর পর্য্যন্ত প্রচণ্ড কাদাময়। মামা, বড়দা, বাবুদা, বাবা, কাকারা সবাই একসঙ্গে গান গাইছে।হঠাৎ বাবুদা গেয়ে উঠলো “এই কানছে রানি কাদায় পড়ে প্রাণে বাঁচে না”। ধুলা হয়ে গেল কাদা। সে সব দিন কি ভোলার।সেই বুড়হ্যা কালীতলার ঘাট থেকে বোলপুকুরের পার দিয়ে, মিত্তি(মিত্র) তলার ভগবতী ঘর হয়ে,’মাহানঠাকরান আর দুর্গেশনন্দিনীর’ নাছ(পাশের রাস্তা) দিয়ে গাইতে গাইতে আমাদের ভগবতী তলায় পৌঁছাতাম।উর্দ্ধবাহু সে নৃত্য আর গান – এক অনাবিল আনন্দে মন ভরে উঠতো।সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানা ঘাত প্রতিঘাতে মনের দ্বার আজ রুদ্ধ। সেই আনন্দের অংশীদার আর হতে পারি না।
আমাদের প্রজন্মে হারু, আমার ছোটো ভাই অরূপ এক নিষ্ঠ সূত্র ধারক ছিল।গ্রামের আরো অনেকের সঙ্গে আমার খুড়তুতো মামাতো ভাইবোন – সব একসঙ্গে সূত্র বা বোল ধারকের সঙ্গে গাইতাম আর আনন্দে নাচতাম, করতালি দিতাম। ভগবতীতলায় এসে গান শেষ হলে শান্তি জল নেওয়ার হুড়োহুড়ি। ‘আমার পড়েনি আমার পড়েনি’, বলে চিৎকার ।পুরুত মশাই, বাবাদের তিনকড়ি জ্যাঠা, শেষে হাঁড়ি উল্টে এক মাথা জল ঢেলে দিতেন কারো কারো মাথায়। তিনকড়িদাদুর ছেলে তামুদা একই ভাবে আনন্দ রসিকতায় এই ধারাবাহিকতা আজও ধরে রেখেছে।শান্তি জল পর্ব শেষ হলে শুরু হতো দিদার কাছ থেকে নাড়কেল নাড়ু আর বাতাসার প্রসাদের জন্য হুড়োহুড়ি কাড়াকাড়ি -একবার পেলে হবে না।আবার চাই।প্রায় নারকেলবিহীন নাড়কেল নাড়ু আর ভাঙা বাতাসা-তাই নিয়ে কাড়াকাড়ি।তখন ওটাই আমাদের কাছে ছিল ‘মজামৃত’।
এরপর বাড়ির কালীতলায় প্রণাম সেরে বাড়ি ফেরা।মনটা একটা কি রকম দুঃখানন্দে ভরে উঠতো।বাড়ি ফিরে ধান-কলাই-সিঁদুর-টাকা-মাছ ছুঁয়ে গুরুজনদের প্রণাম করা। ঠাকুরদাদার ফটো দিয়ে প্রণাম শুরু হতো।
এই রীতি আজও চলে আসছে।আমার খুড়তুতো মেজদি, ভাষাদি, স্নেহ মায়া মমতা সব কিছু দিয়ে বাড়ির এই ট্রাডিশন ধরে রেখেছে।