short story about a tea stall

ক্যাফেটেরিয়া

-সরসিজ বসু মল্লিক

-Guest Post

পাঁচু পাড়ার চায়ের দোকানে কাজ করে । বয়স বেশি নয় । মেরে কেটে ওই বারো কি তেরো ।পাঁচুর মা নেই । বাপ মাতাল । এমনি তে পাঁচুর বাবা তিনকড়ি লোক মন্দ নয় । তবে পেটে দুপাত্তর পড়লেই ব্যাস । তখন তাকে দেখে (থুড়ি রোখে) কে ? পড়াশোনায় নেহাৎ মন্দ ছিলোনা পাঁচু । পাঁচুর মা গত হলেন । বই গেল খাটের তলায় । তারপর গেল বিক্রি হয়ে । মা থাকলে ঠিক বলতেন “ওরে,সরস্বতী কে বিক্রি করে দিলি?” আর কি, মায়ের মুখ এখন আর ঠিক মনেই পরেনা । সব স্মৃতি ঝাপসা । পাঁচুর হাতে এখন চায়ের কেটলি ।

মা স্বপ্ন দেখেছিলেন ছেলে বড়ো হবে। বাবা মা কে নিয়ে ভাঙ্গা বাড়ি থেকে নিয়ে উঠবে রাজপ্রাসাদে । স্বপ্নই থেকে গেলো । বাবাকে নিয়ে খুব একটা অভিযোগ নেই পাঁচুর মনে । অভিযোগ থেকেই বা কি হবে । বাবা তো আর নেশা ছাড়বে না । তিনকড়ির যা অবস্থা তাতে সে কতদিন বাঁচবে , তা নিয়ে বেশ সন্দেহ আছে ।এই পরিবারের অবস্থাটা বোঝানোর জন্য আমি এসব লিখছি ।পাঁচু কিন্তু এসব কথা বেশি ভাবে না । ও লক্ষ্য করেছে এসব ভাবার অনেক হ্যাপা । বুকের ভেতর থেকে কেটলির ধোঁয়ার মতো কি একটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে । দোকানের মালিক জগাই এইরকম হলে বলে “অত দিগ্ঘোসাস ফেলিসনে বাপু । “এতে আবার পাঁচু লজ্জা পেয়ে, জিভ কেটে, কাপ-প্লেট ধুতে শুরু করে দেয় ।

Men enjoying adda at tea stall

ছোট দোকান হলেও , জগাই এর দোকান কিন্তু বেশ ভালোই চলে । জগাই লোকটাও খারাপ নয় ।দুবার পরপর কাচের গ্লাস ভেঙ্গে ফেলার পর ,মাত্র একটা কানমলা দিয়েছিলো ।  রোজ সকালে মর্নিং ওয়াক করার পর  অনেকে আসেন দোকানে । সামনের বেঞ্চিতে বসে চা দিতে বলেন । চা জগাই নিজের হাতেই তৈরি করে । পরিবেশনটা করে পাঁচু । বাবুরা চা এর সঙ্গে ওমলেট দিতে বলেন মাঝেমাঝে । বাবুদের সঙ্গে তার চেনাশোনা হয়ে গেছে । ওই যে , ডানদিকের কোনে যে বাবু ফোনে কি দেখছেন,ওই বাবুটা পুজোর সময় তাকে  কুড়ি টাকা দিয়েছিলো । ওর খুব ভালো লাগে ওই বাবুকে । কথাগুলো বেশ । পাড়ার লোকেরা বলাবলি করে ওই বাবু নাকি অনেক পড়াশোনা করেছেন । মাদ্রাজ না চেন্নাই বলে কি একটা জায়গা থেকে , বাবু পড়াশোনা করে ফিরেছেন কিছুদিন আগে । পাঁচু বুঝতে পারেনা মাদ্রাজ আর চেন্নাই কি দুটো আলাদা জায়গা ? এখন শহরে যান গলায় কালো দড়ি ঝুলিয়ে । সাদা জামা । কালো প্যান্ট । গাড়ি আছে বাবুর । পাঁচুও মনেমনে ভেবেছে মাঝেমাঝে , “আমারও যদি এমন গাড়ি থাকতো । অমন বাবুর মতো সেজেগুজে আপিস যেতে পারতুম কি মজাটাই না হতো ।” আবার পাঁচুর মুখ দিয়ে কেটলির ধোঁয়ার মতো কি একটা বেরিয়ে আসে । একটু ঘুম ঘুম পায় ।

পুজোর পর একটু ঠান্ডা পড়েছে।উত্তর দিক থেকে একটু একটু করে হাওয়া দিচ্ছে । আজ শনিবার । পাড়ার মাঠে ফুটবল খেলা হবে । পাঁচু খেলে না । ও অনেক কম বয়েসে বেশি বড়ো হয়ে গেছে ।চায়ের দোকানে যাওয়ার আগে খেলার মাঠের সামনে পাঁচু দাঁড়িয়েছিল ।ও পাড়ার সন্তু জিজ্ঞেস করলো “কি রে খেলবি নাকি?”পাঁচু বলে “না গো দোকানে যেতে হবে । ” সন্তু কিছু না বলে এগিয়ে যায় । ঐতো আপিস-বাবু ও এসেছেন ।দাঁড়িয়ে আছেন মাঠের সামনে ।বাবু এগিয়ে এলেন । “কিরে দোকানে যাচ্ছিস নাকি?”-বাবু জিজ্ঞেস করেন । পাঁচু কিছু না বলে ওপর নিচে মাথা নাড়ে । “হুম একবার আমার বাড়িতে আসতে পারিস ? কাল তো রবিবার ।দশটা নাগাদ আসিস । জগাইদা কে বলিস ছুটি দিয়ে দেবে ঘন্টাখানেকের জন্য ।” পাঁচু কিছু না বলে ঘাড় নেড়ে চলে যায় । জগাই বোধহয় জানতো পুরো ব্যাপারটা । পাঁচু  ছুটির কথা বলতেই , জগাই রাজি হয়ে যায় ।

দশটার বেশ কিছুক্ষন আগেই বাবুর বাড়ি চলে যায় পাঁচু । বাবু কে দেখে যতটা গম্ভীর মনে হয়,সে ততটা গম্ভীর নয় । বেশ হাসিখুশি লোক । বাড়িতে গিয়েই কাচের প্লেটে কিছু মিষ্টি ইত্যাদি এলো। বাবুর বাড়িতে মা আছেন । তিনিই এসব পরিবেশন করলেন । পাঁচু যখন মিষ্টি খাচ্ছে , তখন বাবু জিজ্ঞেস করলেন “তুই পড়াশোনা কতদুর করেছিস?”পাঁচু উত্তর দেয় “ওই কেলাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছি ।” পাঁচু মিষ্টি খেতে থাকে। বাবু বললেন “জগাই দা বলছিলো তুই দেড় বছর মতো ওর দোকানে কাজ করছিস । তোর পড়াশোনা করতে ইচ্ছে করে না ?”পাঁচু বলতে থাকে “ওতে তো বহুত খরচা গো বাবু  । এইজন্যই তো পড়াটা ছাড়লাম । “বাবু বলে “পড়ার খরচের চিন্তা করিস না । আমাদের কোম্পানির একটা ফান্ড আছে এর জন্য ।আর সরকারি কিছু ব্যবস্থা তো করাই যায়। “তাছাড়া আমি , জগাইদা আছি তোর পাশে । তুই বল পড়তে ইচ্ছুক কিনা?”

কিছুদিন পর থেকেই পাঁচুর নতুন বই কেনা হয়। স্কুল যাওয়ার ইউনিফর্ম আসে । পাঁচ বছর পর পাঁচু চেন্নাই যায় ,পড়াশোনা করতে । বাবুর কোম্পানির ফান্ড আর মাসে মাসে স্কলারশিপের টাকা ব্যায়ভার অনেকটা বহন করে । এর আরো পাঁচ বছর পর ফিরে আসে পাঁচু । নিজের পুরোনো পাড়াকে আর চেনা যাচ্ছে না । অনেক পরিবর্তন এসেছে ।বহুতল বাড়ি উঠেছে অনেক ।মাথা উঁচু করে আকাশটাকে ভালো করে দেখাও যায় না । গিয়ে বাবাকে প্রণাম করেই সোজা চলে আসে বাবুর বাড়িতে । বাবু মানুষটা একই রকম আছেন । পাঁচুকে একবার দেখে একগাল হেসে,বাবু বললেন, “কিরে নিজেকে এবার বাবু বাবু লাগছে?” পাঁচু মাথা নিচু করে থাকে । মিটিমিটি হাসছে সে ।

পাঁচু আর তার বাবু বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো  ।পাঁচু বললো “চলুন বাবু , একটু চায়ের দোকান থেকে ঘুরে আসি । ” পাঁচু সেখানে গিয়ে দেখে চায়ের দোকানটা আর নেই । পাশাপাশি গড়ে উঠেছে অনেকগুলো বহুতল বাড়ি । আর চায়ের দোকানটার জায়গায় একটা ক্যাফেটেরিয়া । না,ক্যাফেটেরিয়ার মালিক অন্য কেউ, জগাই নয় । বাবু হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করেন “আমি ছোটবেলায় তোর মতোই জগাইদার দোকানে কাজ করতাম ।সেখানে এক বাবুর সঙ্গে জগাইদা আমার আলাপ করিয়ে দেন । বাকি ইতিহাস অনেকটা তোরই মতো । মাসখানেক আগে কিছু জবরদখলকারী জগাইদাকে মারধোর করে । জগাইদার তো ফ্যামিলি বলে কিছু নেই । পাশের বাড়িতে কিছুদিনের জন্য বেড়াতে যাচ্ছি বলে সেই যে গেলো ,আর ফিরে আসে নি । অনেক খোঁজ নিয়েও কিছু করা যায়নি । “

New gen cafe

পাঁচুর কিছু বলার ছিল না । সে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল । হঠাৎ পাঁচুর মুখ দিয়ে কেটলির ধোঁয়ার মতো কি একটা বেরিয়ে আসে। ক্যাফেটেরিয়ার ডানদিকের ময়লা ফেলার জায়গায় হলুদ হয়ে আসা ভাঙা চায়ের ভাঁড়গুলো যেন বলে ওঠে “অত দিগ্ঘোসাস ফেলিসনে বাপু । “

এই দুই বাবু ছাড়া পাড়ার সকলেই আনন্দের সঙ্গে তাকিয়ে থাকে ঝাঁ-চকচকে আলো ঝলমলে  ক্যাফেটেরিয়ার দিকে ।

About Sarasij Basu Mallick

Sarasij comes from Sheakhala, a small town in the Hooghly district. He is a Mathematics geek studying at Serampore College.
Books have always fascinated him from his early childhood and they drive him to ‘think’ differently. In his words, “Yes any form of art requires thinking. But, while writing, I have to realize that thinking is not the key to good stories. Good stories go much beyond writing – It needs to explore culture – politics – history and much more! I try to encapsulate some of my thought through my writings. And, I have an irrefragable idea that one day my pen will help me to explore myself.”

Disclaimer: The opinions expressed in this post are the personal views of the author. They do not necessarily reflect the views of www.kolkatafusion.wordpress.com. Any omissions or errors are the author’s and KolkataFusion does not assume any liability or responsibility for them.

One thought on “ক্যাফেটেরিয়া

Comments are closed.