-অঙ্গনা
– Guest Post
আমি ততোখানি সমাজ-মুখী নই যতখানি আমি আত্ম-মুখী। আমার এই সমাজ–বিমুখিনতা কি আমার উত্তরাধিকার? এই বিষয়ে ভাবতে বসলেই আজকাল আমি আমার ঠাকুমাকে নিজের মধ্যে খুঁজে পাই; নাকি সামাজিকতার প্রশ্নে আমি আমার ঠাকুমা হয়ে বাঁচতে চাইছি! নিশ্চিত জানিনা। হয়তো এই লেখা সেই উত্তর খোঁজার একটা প্রচেষ্টা। আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার শ্যামবাজার অঞ্চলে, একান্নবর্তী পরিবারে। জ্ঞান হবার পর থেকে আমি যেমন দেখেছি ঠাকুমাকে তাতে আমার মনে হয়েছে তিনি বেশ দাপুটে ছিলেন, খুব র্যাডিকাল না হয়েও বেশ স্বতন্ত্র ছিলেন। সেজন্যে অনেক নিন্দেমন্দ তাঁকে কুড়োতে হয়েছিলো। (যেমন তিনি থিয়েটার, বায়স্কোপ দেখতে খুব ভালবাসতেন। সেই ভালবাসা এতোটাই ছিল যে জামাইয়ের সঙ্গেও সিনেমা দেখতে যেতে তিনি পিছপা ছিলেন না। আমি ছোটবেলায় ঠাকুমার নিজের জামাইয়ের সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাওয়ার ঘটনাকে নিয়ে পরিবারের অন্যদের মুখে অনেক পরিহাস, নিন্দে, ছিছিকার শুনেছি।) তবে সেসবে কান না দিয়ে এবং সংসার টিকিয়ে রাখতে ন্যূনতম যা দরকার সেটুকু বজায় রেখে ঠাকুমা নিজের শর্তে জীবন কাটিয়েছেন। ঠাকুমা খুব বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। আমি ঠাকুমাকে বিধবা অবস্থাতেই দেখেছি, কারণ আমার বাবার ১২ বছর বয়সে আমার ঠাকুরদা মারা যান। জীবনে স্বামীর অভাব বা অনুপস্থিতি আমার ঠাকুমার ব্যক্তিত্বে কোন পরিবর্তন আনতে পারে নি। ঠাকুমার ব্যক্তিত্বের বলিষ্ঠতায় কোন ভাঙ্গন ধরেনি তাঁর স্বামীবিয়োগে। বিধবা হয়ে তাঁর ব্যক্তিত্ব আগের থেকে বেশি বলিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল কিনা তা আমার পক্ষে জানার আজ আর কোনও উপায় নেই, যদিও সেই প্রশ্ন মনে জাগে।
ঠাকুমাকে দেখেছিলাম আত্মীয়–পরিজনদের খুব একটা তোয়াক্কা না করতে। সমাজের অনেক নামী-দামী ব্যক্তিত্ব পরিজন-মণ্ডলীতে থাকা সত্ত্বেও তাঁদের কারো সঙ্গে গায়ে পড়ে লৌকিকতা বা সামাজিকতা করার নিদর্শন আমি অন্ততঃ জ্ঞানতঃ দেখিনি। কেবলমাত্র নিজের পরিবারের গণ্ডীর ভেতরেই যেটুকু। বৃহত্তর সামাজিকতা বা লৌকিকতা পালনের ধূম কখনও দেখেছি বলে স্মরণে আসে না। তবে সমাজের নিয়ম মেনে জামাইদের প্রতি বিশেষ আদর–আপ্যায়ন করতে ভুল করেননি কখনও। আর নিজের পুত্রবধূদের শাসন করতেও ভোলেন নি। বাড়ির বড়দের কাছে শুনেছি, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আত্মীয়স্বজন ঠাকুমার সংসারে এসে থেকেছেন, অনুগ্রহ নিয়েছেন, যখন যেমন যার প্রয়োজন হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁদের সঙ্গেও যে ঠাকুমার বিশেষ হদ্যতা বা তারা যে কৃতজ্ঞতাবশে ঠাকুমাকে বিশেষ সমাদর করছে তেমনটাও দেখিনি। বরং এর বিপরীতটাই চোখে পড়েছে। কেউই ঠাকুমার সেই আতিথ্য মনে রাখেনি।
সামাজিকতা আসলে প্রয়োজনের লেনদেন। যেকোনও সামাজিক সম্পর্কই তাই। এই বিষয়ে ঠাকুমার একটি উক্তি বা উচ্চারণ আমি খুব ছোটবেলায় শুনেছিলাম এবং তা সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে দাগ কেটে গেছিলো এতোটাই যে আজও অতি স্পষ্ট সেই স্মৃতি। “আমি কাউকে দিইও না, কারো থেকে নিইও না” – সামাজিক লেনদেনের পরিসরের বাইরে নিজেকে রাখার এই অবস্থান ঠাকুমা কেন, কীভাবে এবং কবে থেকে গ্রহণ করেছিলেন, এর প্রেক্ষাপট বা ইতিহাস কিছু ছিল কিনা তা আজ আর জানা সম্ভব না। তবে এই কথা আমাকে সারাজীবন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। সামাজিকতার নিরিখে এই উচ্চারণ অনুমোদনযোগ্য নয়, তাই সেই সময়েও ঠাকুমা সমালোচিত হয়েছিলেন এর জন্যে, সেও আমার পরিষ্কার মনে আছে। কিন্তু আমি যে এই উক্তির অভিঘাত থেকে আজও মুক্তি পেলাম না!
আমি তখন ক্লাস ফাইভ। একদিন সকালে ঠাকুমার হঠাৎ সেরিব্রাল স্ট্রোক হোল। উঠে দাঁড়াতে পারছেন না, মুখ–মাথা এলে গেছে। সেদিন দুপুরে আমি হাতে করে ভাত চটকে নরম করে ঠাকুমাকে খাইয়ে দিলাম। ঠাকুমা শুয়ে শুয়ে খেলেন। সে যেন এক ভূমিকা বদলের দৃশ্যপট। ছোটবেলায় আমি খুব ধীরে ধীরে সময় নিয়ে খেতাম। ঠাকুমা গল্পের পর গল্প বলে বলে আমাকে খাওয়াতেন, বাড়ির উঠোনে, পিঁড়ে পেতে বসে। আমি এত দেরি করতাম খেতে যে ঠাকুমার হাতে ভাত শুকিয়ে চড়চড় করত। খেতে খেতে আমি পা ছড়িয়ে বসলে ঠাকুমা বলতো, “মেয়েরা পা ছড়িয়ে বসলে দূরে শ্বশুরবাড়ি হয়”। রূপকথার নানা গল্প বলার পর অনেক সময় বলতেন, “ছেলেরা হোল সোনার আংটি, সোজা হোক বা বাঁকা – তাদের দাম কখনো কমে না”। সেই ঠাকুমা অসুস্থ হয়ে পড়ে যখন ‘ভাগের মা’ হয়ে উঠতে চলেছেন বলে বুঝতে পারছেন, তখন একদিন বললেন, “আমি এখন গরীব, আমার কিছু নেই। তোমরা সব বড়লোক, আমাকে আর তোমরা পুঁছবে কেন!” “টাকা যার জোর তার”। এই রকম টুকরো টুকরো নানা কথার মধ্যে দিয়ে ঠাকুমা আমাকে জীবনের সার চিনিয়ে দিয়েছিলেন সেই কাঁচা বয়সেই। এতো আলো, এতো হাসি, গা ঘসাঘসি সব ততক্ষণই যতক্ষণ মানুষের আর্থিক ও শারীরিক সামর্থ্য থাকে। ততোদিনই সমাজে, সংসারে মানুষের মূল্য, সবাই তাকে চায়। যেদিন সামর্থ্য ফুরোয় সমাজ, সংসার কেউ পোঁছে না।
ছোটবেলায় ঠাকুমার পাশে, ঠাকুমার কাছে রাতে শুতাম। ঘুমনোর আগে ঠাকুমা অনেক রকম গল্প বলতেন। নিজের জীবনের কম বয়েসের নানা গল্পও থাকতো তার মধ্যে। শিশুকালের গল্প, কিশোরীবেলার গল্প। ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয় আমার ঠাকুরদার সঙ্গে। ঠাকুমার থেকে দাদু ১৪ বছরের বড় ছিলেন। বিয়ের আগে ঠাকুমার যে নাম ছিল তা শ্বশুরবাড়িতে বদলে দেওয়া হয়। যে জীবনের প্রথম ১৪ বছর ‘লীলা’ বলে নিজেকে জানলো সে বিয়ের পর থেকে হয়ে গেল ‘রাণু’। বিয়ে মানে নবজন্ম, নতুন পরিচয় – আগের সব কিছুকে মুছে ফেলে!! কিন্তু ঠাকুমা তো ভোলেন নি, ভুলতে পারেন নি। বয়ে বেরিয়েছেন সঙ্গোপনে, আমার কাছে গল্পচ্ছলে ফিরে পেতে চাইতেন নিশ্চয়ই নিজের সেই জোর করে ভুলে থাকতে বাধ্য হওয়া কুমারী সত্তাকে। কেউই কি পারে ভুলতে? আদৌ কি ভোলা সম্ভব? আর কেনইবা ভুলতে হবে? এর পেছনেও তো সেই আদানপ্রদানের গল্প! স্ত্রীধন আদানপ্রদানের ওপরেই তো গড়ে উঠেছে এবং টিকে আছে আজকের এই সভ্য মানব সমাজ। এক পরিবার থেকে আরেক পরিবারে তার হস্তান্তর, মালিকানা বদল। কাজেই সেই স্ত্রীধনকে ব্যক্তিসত্তা হিসেবে স্বীকৃতি বা তার স্বতন্ত্র আত্মপরিচয়ের দাবি সামাজিক লেনদেনের পরিসরে জায়গা পায়না স্বাভাবিক ভাবেই। স্ত্রীধন থেকে ব্যক্তি-নারী হয়ে উঠতে বরং পেরোতে হয় অনেক ঝড়, বৃষ্টি, রোদ্দুর।
ঠাকুমার কাছেই আরও জানতে পারি, ঠাকুমার বাবার বাড়ি ছিল রংপুরে। ঠাকুমার মা যমজ মেয়ের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। ঠাকুমাকে পাঠানো হয় মামারবাড়ি রাজাভাতখাওয়ায়। আমার দাদুর সঙ্গে বিয়ের আগে আরও এক পরিবারে ঠাকুমার বিয়ের প্রস্তাব অনেকদূর এগিয়েছিল। কোনো এক জমিদারনন্দনের সঙ্গে কিছুদিন কোর্টশিপও চলেছিল তাঁর। কিন্তু বৈষয়িক লেনদেনের প্রশ্নে এসে ঠেকে যায় বিষয়টা। ঠাকুমাকে এরকম অনেকবিধ মূল্য চুকিয়ে তবেই সামাজিক লেনদেন বিষয়ে প্রজ্ঞা অর্জন করতে হয়েছিলো।
লেনদেনই মানুষের সমাজ জীবনে একমাত্র সত্য এবং তা বৈষয়িক লেনদেনই বটে – ঠাকুমা আমাকে দিয়ে গিয়েছেন তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত এই প্রজ্ঞা। সেই প্রজ্ঞা আজ আমার জীবনের আলোকবর্তিকা।
About Angana
Angana teaches Philosophy in a government college and runs an educational trust for the students belonging to the Sundarban Area of West Bengal. An excellent photographer and writer herself, she loves travelling to offbeat locations.
Disclaimer: The opinions expressed in this post are the personal views of the author. They do not necessarily reflect the views of www.kolkatafusion.wordpress.com. Any omissions or errors are the author’s and KolkataFusion does not assume any liability or responsibility for them.